ডিজিটাল যুগে মুসলমানের দায়িত্ব ও করণীয়: এক বিস্তৃত আর্টিকেল
ভূমিকা
ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি ইবাদত ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাকাত—এই পবিত্র আর্থিক ইবাদতটি কোনো দয়া কিংবা করুণা নয়; বরং এটি ধনীদের সম্পদের মাঝে গরীবের ‘আল্লাহ-প্রদত্ত অধিকার’। কোরআনে যাকাতকে “ফরজ” বলা হয়েছে। অথচ আজ আমরা এই ফরজ বিধানটিকে এমনভাবে ব্যবহার করছি যেন এটি কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল মাত্র। বছরের পর বছর ধরে, যাকাতের বড় অংশ চলে যাচ্ছে মাদরাসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে—অনেক ক্ষেত্রে হিসাববিহীন ও অকার্যকর পদ্ধতিতে। অথচ আমাদের পাশেই রয়েছেন হাজারো সম্মানী দরিদ্র, যারা লজ্জায়, সম্মানে কারো কাছে কিছু বলেন না—চুপচাপ, নিঃশব্দে, ক্ষুধা আর দুঃখে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন।
এই প্রবন্ধে আমরা এই ভুল প্রবণতার গভীরে যাবো, দেখবো কোরআন-সুন্নাহ কী বলছে, এবং বুঝবো—আজ আমাদের কী করণীয়।
১. যাকাতের কোরআনিক কাঠামো: কাদের জন্য এই ফরজ?
আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যাকাতের আটটি খাত নির্ধারণ করেছেন—এটি কোনো ইমামের ফতোয়া নয়, বরং সরাসরি আল্লাহর বিধান:
"إِنَّمَاالصَّدَقَاتُلِلْفُقَرَاءِوَالْمَسَاكِينِ..."
এই খাতগুলো হলো:
❗লক্ষ্য করুন, এখানে কোথাও বলা হয়নি যে যাকাত প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দযোগ্য।বরং যাকাত বরাদ্দ করা হয়েছেমানুষের জন্য—প্রতিটা খাতেই ব্যক্তি আছে, প্রতিষ্ঠান নয়।
২. যাকাত: সম্মানী দরিদ্রদের অধিকার
আজকের সমাজে এমন বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা অদৃশ্য কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তারা শিক্ষক ছিলেন, সমাজসেবক ছিলেন, কখনো হয়তো ছোট ব্যবসা চালাতেন। হঠাৎ করেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন—দূর্ঘটনা, বার্ধক্য, বা পুঁজি হারানোর কারণে। তারা কারো কাছে হাত পাতেন না, তাই আমরা বুঝতেই পারি না—ওরা আজ কী অবস্থায় আছে।
🔹এক সময়ের স্কুল শিক্ষক আজ ঔষধ কেনার টাকা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে পড়ে আছেন।
🔹একা মা—তিন সন্তান নিয়ে এক কামরার ঘরে, খাবার নেই, কাজ নেই, কিন্তু নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করে যাচ্ছেন নীরবে।
🔹বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে—বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে পড়ালেখা ঝুলে গেছে, কিন্তু সে কাউকে কিছু বলছে না, প্রতিদিন না খেয়ে লাইব্রেরি যাচ্ছে।
🔹শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার—যারা অভাবের লজ্জায় আত্মীয়-স্বজনের মাঝেও যাকাতের আবেদন করতে পারে না।
🕌ইসলামের চোখে এদের খুঁজে বের করা, গোপনে সাহায্য করা—এই হলো প্রকৃত তাকওয়া।
কোরআনে এসেছে, "তুমি তাদের চেহারা দেখে বুঝবে না যে তারা অভাবগ্রস্ত। তারা মানুষের কাছে হাত পাতে না।" (সূরা বাকারা: ২৭৩)
৩. মাদরাসার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি: ভালোবাসা হোক ভারসাম্যময়
নিঃসন্দেহে মাদরাসা ইসলামের ঘাঁটি, তারা দ্বীনের খেদমত করে। কিন্তু অনেক মাদরাসা যাকাতকে বাজেটের প্রধান উৎস বানিয়ে ফেলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য—অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা যাকাতের নামে সংগ্রহ করে অথচ সেই পরিমাণ খরচের স্বচ্ছ হিসাব দেয় না।
একজন মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাসে হাজার হাজার টাকা ভাতা পান, অথচ সেই মাদরাসার ছাত্ররা অর্ধপেট খেয়ে পড়ছে। এ কি যাকাত ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি?
আলেমদের মতে, যদি কোন ছাত্র বাস্তবে ফকির বা মিসকিন হয়, তাহলেব্যক্তি ছাত্রকেযাকাত দেয়া যাবে, প্রতিষ্ঠানকে নয়।
৪. আমাদের সমাজের নিরব কান্না: একটি বাস্তব চিত্র
এরা কারা? এরা সেই মানুষ, যাদের জন্য যাকাত ফরজ হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো তালিকা নেই, কোনো আবেদনপত্র নেই, কেউ এসে যাকাত দেয় না।
৫. আমাদের দায়িত্ব: যাকাতের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা
✅আত্মসমালোচনা করুন – যাকাত কোথায় দিচ্ছি? যথার্থ খাতে যাচ্ছে কি?
✅গোপনে অনুসন্ধান করুন – পরিবার, পাড়া-মহল্লা, মসজিদের পাশেই এমন মানুষ আছে যাদের আমরা চিনিই না।
✅যাকাত ফাউন্ডেশন তৈরি করুন – পেশাদার, বিশ্বস্ত, স্বচ্ছ ফাউন্ডেশন যেটি সঠিক খাতে যাকাত পৌঁছে দিতে পারবে।
✅ধর্মীয় বক্তাদের দায়িত্ব – খুতবা, বয়ান ও আলোচনায় বারবার তুলে ধরতে হবে—যাকাত শুধু মাদরাসার জন্য নয়।
✅বিত্তবানদের চোখ খুলুন – একেকজন ধনী ব্যক্তি যদি প্রতিবছর মাত্র ২-৩টি পরিবারের পাশে দাঁড়ায়, অনেক কিছু বদলে যেতে পারে।
উপসংহার
যাকাত কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অর্থনীতি নয়—এটি মানবতার ইবাদত। আমরা যখন যাকাতকে শুধুমাত্র মাদরাসার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ করি, তখন একজন নিঃস্ব মানুষ হারিয়ে যায়। আমরা চোখে দেখি না, কানেও শুনি না, কারণ আমাদের সমাজ যাকাতকে প্রতিষ্ঠানমুখী বানিয়ে ফেলেছে, মানুষমুখী নয়।
এ সমাজে সম্মানী দরিদ্রেরা প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে—তারা শুধু অর্থ চায় না, তারা সম্মান চায়, তারা বেঁচে থাকতে চায় মর্যাদার সঙ্গে। ইসলাম এই শ্রেণিকেই প্রথমে যাকাত দিতে বলে।
আজ আমাদের তাওবা করার দিন। ভুল ভাঙানোর দিন। যাকাতকে ফিরিয়ে আনুন তার আসল খাতে—তাহলেই বরকত হবে, সামাজিক ভারসাম্য আসবে, আমরা আসলেই মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবো।