Dawatul Islam | ইসলামী আন্দোলন ও রাজনীতি

রবিবার, ০২, নভেম্বর, ২০২৫ , ১৮ কার্তিক ১৪৩২

ইসলামী আন্দোলন ও রাজনীতি
২৭ অক্টোবর ২০২৫ ১০:৩১ মিনিট


রেদওয়ান রাওয়াহা

ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এক নির্ভেজাল জীবনবিধান। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন—

اِنَّالدِّیۡنَعِنۡدَاللّٰہِالۡاِسۡلَامُ
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দ্বীন।”(সূরা আলে ইমরান: ১৯)

আমরা জানি, আল্লাহর প্রদত্ত এই ইসলাম— এই জীবনবিধানে কোনো ঘাটতি নেই, কোনো ত্রুটি নেই। এটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন—

اَلۡیَوۡمَاَکۡمَلۡتُلَکُمۡدِیۡنَکُمۡوَاَتۡمَمۡتُعَلَیۡکُمۡنِعۡمَتِیۡوَرَضِیۡتُلَکُمُالۡاِسۡلَامَدِیۡنًا
আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”(সূরা মায়িদা: ৩)

এরপর আল্লাহ তায়ালা আমাদের সতর্ক করেছেন যে, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ, পথ বা মতাদর্শ গ্রহণ করলে তা কখনোই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

وَمَنيَبْتَغِغَيْرَالْإِسْلَامِدِينًافَلَنيُقْبَلَمِنْهُوَهُوَفِيالْآخِرَةِمِنَالْخَاسِرِينَ
যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অনুসন্ধান করে, তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন।”(সূরা আলে ইমরান: ৮৫)

প্রথম আয়াতের দিকে লক্ষ্য করুন— আল্লাহ বলেছেনআদ-দ্বীন” (الدين), শুধু “দ্বীন” (دين) বলেননি।
দ্বীনঅর্থ — জীবন পরিচালনার এক পন্থা, এক বিধান।
আরআদ-দ্বীনঅর্থ — নির্দিষ্ট সেই একমাত্র পথ।

ইমাম মওদূদী (রহ.) বলেন, ইংরেজিতেThis is a wayআর“This is the way”—এই দুই বাক্যের অর্থের পার্থক্যের মতোই “দ্বীন” (دين) ও “আদ-দ্বীন” (الدين)-এর পার্থক্য। অর্থাৎ ইসলাম কোনো একটি পথ নয়, বরং একমাত্র সঠিক ও পূর্ণ জীবনব্যবস্থা।

যেহেতু ইসলাম আল্লাহর নির্ধারিত একমাত্র পরিপূর্ণ জীবনবিধান, সেহেতু এর বাইরে কোনো আইন, তত্ত্ব বা মতবাদ আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামেই রয়েছে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা— আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব দিকেই।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের দুনিয়ায় ইসলাম সেই মর্যাদায় আসীন নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক— কোনো ক্ষেত্রেই ইসলামী জীবনব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। এই অপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার মহৎ লক্ষ্যেই আল্লাহভীরু মানুষ ইসলামী আন্দোলনের কাফেলায় শরিক হয়। তারা আল্লাহর প্রদত্ত “আদ-দ্বীন” প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে।

ইসলামী আন্দোলন যেমন ব্যাপক, তেমনি এর চিন্তা ও দর্শনও বিস্তৃত। ইসলাম যেভাবে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, ইসলামী আন্দোলনও তেমনই একটি সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা। শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.) বলেন—

প্রতিষ্ঠিত কোনো কিছুকে অপসারণ করে সেখানে নতুন কিছু কায়েম করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, প্রাণান্তকর সংগ্রামই হচ্ছে আন্দোলন।”

অতএব, ইসলামী আন্দোলন কোনো ক্ষণস্থায়ী জাগতিক উদ্দেশ্যের জন্য নয়। এটি এমন একটি আন্দোলন যার লক্ষ্য পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষকে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা।

জাগতিক আন্দোলনগুলো সাধারণত নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক— অর্থনৈতিক দাবি, রাজনৈতিক ক্ষমতা বা ব্যক্তিগত স্বার্থ। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কেবল দুনিয়ার জয়-পরাজয়ের দিকে লক্ষ্য রাখেন না। তারা কাজ করেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

রাজনীতি ইসলামী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু সেটিই পুরো আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, ক্ষমতা অর্জনের জন্য নয়। তারা রাজনীতিতে অংশ নিলেও ইসলামী আদর্শকে বিসর্জন দেয় না, বরং রাজনীতিকে দ্বীনের অংশ হিসেবেই দেখে।

ইমাম হাসান আল-বান্না (রহ.) সুন্দরভাবে বলেছেন—

আমরা তোমাকে ডাকছি ইসলামের মহান শিক্ষার দিকে, ইসলামের কল্যাণময় পথের দিকে। যদি এটাকে তোমরা রাজনীতি মনে করো, তবে এটাই আমাদের রাজনীতি।”

তিনি আরও বলেন—

তোমাদের অন্তরে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করো, তাহলে আল্লাহ সারা পৃথিবীতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন।”

অর্থাৎ, ইসলামী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের অন্তরে ও সমাজে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি— সবই এই পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতের অংশ।

ইমাম মওদূদী (রহ.) তাঁর “দাওয়াত ও কর্মনীতি” গ্রন্থে লিখেছেন—

নিছক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়; বরং মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করাই আমাদের লক্ষ্য।”

এমনকি শাইখ ইউসুফ আল-কারজাভীও বলেন—

ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে চালিকা শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এক নিরন্তর প্রচেষ্টা।”

অতএব, ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য কোনো রাজনৈতিক সাফল্য নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালীন মুক্তি।

আল্লাহ তায়ালা বলেন—

يَغْفِرْلَكُمْذُنُوبَكُمْوَيُدْخِلْكُمْجَنَّاتٍتَجْرِيمِنتَحْتِهَاالْأَنْهَارُ
আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়।”(সূরা সফ: ১২)

فَاسْتَبْشِرُوابِبَيْعِكُمُالَّذِيبَايَعْتُمبِهِ
তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যে বায়আত করেছো, তাতে আনন্দিত হও; এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।”(সূরা তাওবা: ১১১)

সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উচিত সত্যের পথে অবিচল থাকা, মিথ্যার প্রাবল্যে বিচলিত না হওয়া। ইমাম মওদূদী (রহ.) বলেছেন—

মিথ্যার প্রাবল্য দেখে ঘাবড়াবে না; কারণ মিথ্যা কখনো ঝড়ের বেগে আসে, আবার বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়।”

সবশেষে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের একটাই পরিচয়—তারা ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, আল্লাহর সন্তুষ্টির সৈনিক।রাজনীতি, জ্ঞানচর্চা, সমাজসেবা, সংস্কৃতি— যা-ই করুক না কেন, তা যেন হয় দ্বীনের স্বার্থে, ইসলামের বিজয়ের লক্ষ্যেই।


লেখক:প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সূত্র: shibir.org.bd

সব সংবাদ