Dawatul Islam | আস্থা: ইসলামী দাওয়াতের এক অপরিহার্য স্তম্ভ

রবিবার, ০২, নভেম্বর, ২০২৫ , ১৮ কার্তিক ১৪৩২

আস্থা: ইসলামী দাওয়াতের এক অপরিহার্য স্তম্ভ
৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১২:১৪ মিনিট

আল্লাহর প্রশংসা যিনি এক, অনন্য, চিরস্থায়ী আশ্রয়স্থল—যিনি প্রত্যেক প্রাণের কাজের ওপর অভিভাবক এবং যিনি প্রত্যেককে তার কর্ম অনুযায়ী প্রতিদান দেবেন। শান্তি ও আশীর্বাদ বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর, যিনি আবদুল্লাহর পুত্র, তাঁর পরিবার, সাহাবা এবং যারা তাদের পথ অনুসরণ করে তাদের ওপর। এরপর...

আস্থা (বিশ্বাস)ইসলামি আহ্বানের অন্যতম স্তম্ভ। এটি মুসলিম সমাজের মানসিক ও সংগঠনগত শক্তির একটি উৎস, এবং এটি আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের আন্তরিকতার একটি ফল। সমাজের দৃঢ়তা নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের পারস্পরিক আস্থার ওপর, আর জামাতের শক্তি নির্ভর করে সমাজের নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাসের ওপর। আজ আমাদের এই স্তম্ভের অর্থ ও প্রভাব নিয়ে নিজেদের পুনর্মূল্যায়ন করার বড় প্রয়োজন রয়েছে।

একজন মুসলমানের ইসলামি আহ্বানের পথে যাত্রা এবং সমাজে ইসলামের জন্য তার কাজ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ সে তার সময়, শ্রম, অর্থ, আত্মা ও সমস্ত কিছু ব্যয় করছে পরকালের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য।

অতএব, তার উচিত সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও স্থায়ী আশ্বাস রাখা—এই পথের নিরাপত্তা সম্পর্কে, যে দল বা সংগঠনের মাধ্যমে সে ইসলামি দায়িত্ব পালন করছে তার সঠিকতা সম্পর্কে, তার নেতৃত্ব ও ভাইদের প্রতি বিশ্বাস রাখা, যেন সে দ্বিধাহীনভাবে কাজ করতে পারে, নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে চলে, সহযোগিতা করে এবং দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর মতো সংহত হয়। বরং তার নিজের প্রতিও আস্থা থাকা উচিত যে, আল্লাহর সাহায্যে সে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সক্ষম হবে।

আজ আমাদের এই আস্থার কত প্রয়োজন!

প্রথমতঃ আস্থার প্রয়োজনীয়তা

আস্থার প্রয়োজন সর্বদা, কিন্তু বিশেষ করে আজ—যখন বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের ঐক্য নষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত। আল্লাহ মিশরকে অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু এর পর থেকেই আমাদের সংগঠন—এর নেতৃত্ব, পদ্ধতি, ও সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, অপবাদ ও গুজব ছড়ানো শুরু হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে আমাদের নেতৃত্বের প্রতি সদস্যদের আস্থা নষ্ট করতে। তারা সংবাদমাধ্যমে ভ্রান্ত খবর, বিকৃত বক্তব্য ও মিথ্যা গল্প ছড়াচ্ছে, যাতে ঐক্য ভেঙে যায়।

ইমাম হাসান আল-বান্না (রহ.) তাঁর “আমাদের আহ্বান” গ্রন্থে বলেছেন:

যে ব্যক্তি আমাদের সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে, আমাদের প্রতি মন্দ ধারণা রাখে, সে আমাদের দেখে বিকৃত দৃষ্টিতে... আমরা তার জন্য দোয়া করি, যেন আল্লাহ তাকে ও আমাদেরকে সত্যকে সত্য হিসেবে চিনে তা অনুসরণ করার এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে চিনে তা পরিহার করার তাওফিক দেন...”


দ্বিতীয়তঃ নতুন পর্যায়ে আস্থার গুরুত্ব

বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজ আজ স্বাধীনতার নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে, যেখানে মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ এসেছে। এতে সংগঠনের কাজ, নেতৃত্ব ও সদস্যদের পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা হবে।
অতএব, সমাজের সাথে কাজের দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি আমাদের ভেতরকার ঐক্য ও সংহতি রক্ষা জরুরি—শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংগঠনের মূলনীতি ও পারস্পরিক আস্থা দৃঢ় করতে হবে।


আস্থার স্তম্ভ সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা

আস্থা ইসলামী জামাতের দশটি বায়আতের স্তম্ভের একটি। ইমাম আল-বান্না (রহ.) বলেন:

আস্থা বলতে আমি বুঝাই—সৈনিকের তার নেতার যোগ্যতা ও আন্তরিকতার ওপর গভীর নির্ভরশীলতা, যা জন্ম দেয় ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের।”

আস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো—

১. এটি হৃদয়ের অবস্থা—আরোপিত নয়, বরং ঈমানের ফল।

২. এটি আত্মার গভীর বাস্তবতা, বাহ্যিক শ্লোগান নয়।

৩. এটি পারস্পরিক—নেতা ও অনুসারীর মধ্যে উভয় দিকেই থাকতে হবে।

৪. এর প্রমাণ চারটি গুণে প্রকাশ পায়—ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য।


আস্থার রূপসমূহ

ক) পদ্ধতির প্রতি আস্থা:
একজন মুসলমানের দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ইসলামই আল্লাহপ্রদত্ত একমাত্র সত্য পথ, এবং মানবজীবনের কল্যাণ একমাত্র এই পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।

খ) নেতৃত্বের প্রতি আস্থা:
প্রয়াত মুসতফা মাশহুর (রহ.) বলেন:

নেতৃত্বের প্রতি সীমাহীন ও দৃঢ় আস্থা থাকা অপরিহার্য, কারণ দাওয়াহর সফলতা নির্ভর করে নেতা ও অনুসারীর পারস্পরিক আস্থার ওপর।”
তিনি বলেন, সন্দেহ দেখা দিলে তা খোলাখুলি আলোচনা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে দূর করতে হবে—গুজব বা অপবাদে কান দেওয়া চলবে না।

গ) ভাইদের প্রতি আস্থা:
ভাইদের ছোট করে দেখা যাবে না; তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, মু’মিন তার ভাইয়ের আয়না।”পারস্পরিক আস্থাই ঐক্যের ভিত্তি।


সমালোচনা ও সন্দেহের পার্থক্য

শত্রুরা সবসময় এই আস্থা দুর্বল করার চেষ্টা করবে—গুজব, বিকৃতি ও অপবাদ ছড়িয়ে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণযোগ্য, ধ্বংসাত্মক নয়। সত্যিকারের পরামর্শ ভালোবাসা ও সদিচ্ছার মাধ্যমে আসে; সন্দেহ ও অপবাদ তার বিপরীত।

অতএব, আমাদের উচিত—গঠনমূলক পরামর্শ গ্রহণ করা, আর সন্দেহ ও ধ্বংসাত্মক সমালোচনা উপেক্ষা করা।
আমরা যেন এসব অপবাদে বিভ্রান্ত না হই, কারণ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কেও মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

আর তুমি তাদের কথায় দুঃখিত হয়ো না।” (ইউনুস: ৬৫)
তারা তোমাকে নয়, আল্লাহর আয়াতকেই অস্বীকার করে।” (আন’আম: ৩৩)
তোমরা অবশ্যই তোমাদের ধন-সম্পদ ও প্রাণে পরীক্ষা হবে... কিন্তু যদি ধৈর্য ধরো, তা দৃঢ়তার কাজ।” (আল ইমরান: ১৮৬)


আমাদের করণীয়

প্রত্যেক সদস্যের কর্তব্য হলো—আস্থাকে দুর্বল হতে না দেওয়া। নেতৃত্বের উচিত সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রাখা, সন্দেহ দূর করা, আর সদস্যদের উচিত অমূলক গুজবে কান না দেওয়া। যদি কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি আসে, তা সরাসরি ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত—অন্যদের মধ্যে ছড়ানো নয়।

আল্লাহ বলেন:

হে মুমিনগণ! যদি কোনো অসৎ ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তা যাচাই করে নাও, যেন অজান্তে কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতি না করো।” (হুজুরাত: ৬)


যদি আমরা কোনো মিথ্যা অভিযোগের জবাব দিই, তারা আবার নতুন অপবাদ রচনা করবে। তাই সর্বোত্তম প্রতিক্রিয়া হলো—কাজ চালিয়ে যাওয়া ও আমল বৃদ্ধি করা।

যদি কেউ নেতৃত্বের লোভে বিভ্রান্ত হয়ে সংগঠনবিরোধী আচরণ করে, সন্দেহ ছড়ায়, তবে সে সঠিক পথে নেই। সত্যিকারের পরামর্শ হলো প্রতিষ্ঠিত চ্যানেলের মাধ্যমে।


উপসংহার

আমরা আল্লাহর নিকট দোয়া করি, যেন তিনি আমাদের আহ্বানকে সংরক্ষণ করেন, আমাদের ভ্রাতৃত্বে বরকত দান করেন, আমাদের নেতৃত্বকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, এবং আমাদের ঐক্যকে দৃঢ় করেন।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—এই দাওয়াহ আল্লাহর দাওয়াহ, তিনি নিজেই একে রক্ষা করবেন।

তারা চায় আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে; কিন্তু আল্লাহ তাঁর আলো সম্পূর্ণ করবেন, যদিও কাফেররা অপছন্দ করে।” (আস-সাফ: ৮)

আর আমাদের শেষ কথা হলো—সব প্রশংসা আল্লাহ, বিশ্বজগতের রবের জন্য।

 

সব সংবাদ